পেশোয়ারি খাবার পাকিস্তানের একটি জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী রান্নার ধরন যা মূলত খাইবার পাখতুনখোয়া অঞ্চলে বিখ্যাত। এর খাবারে বিশেষ ধরনের মশলা ও রান্নার কৌশল ব্যবহৃত হয়, যা একে স্বাদে অতুলনীয় করে তোলে। আজ আমরা আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি জনপ্রিয় পাকিস্তানি পেশোয়ারি রেসিপি, যা ঘরেই সহজে তৈরি করা যায়।
পাকিস্তানি পেশোয়ারি রেসিপি – একটা স্মৃতি
আমার নানার জন্মস্থান পাকিস্তানের পশ্চিম করাচিতে। সাতচল্লিশের পার্টিশনের সময় সবুজ রঙের ফুলহাতা শার্ট আর হাফপ্যান্ট পড়ে বাংলাদেশে চলে আসে। কিভাবে কেমনে কোন অলৌকিক বলে চলে আসে সে এক অজানা ঘটনা। তখন বয়স মাত্র দশ কি বারো তাঁর। পাকিস্তানের সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান সে। ঘটনা ক্রমে এদেশে এসে এদেশিও হয়ে ওঠেন। ছোট বেলায় কঠিন বাস্তবার মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন। একাত্তুরের পরে ঢাকার মধ্যে জমিজমা কিনে নিজের বসতভিটা তৈরি করেন। আজকের লেখার মূল উপপাদ্য বিষয় এটি নয়। ব্যাকগ্রাউন্ডটা বলছি সংগত কারণে।
নানার মা ছোট বেলায় বীফ দিয়ে একটি রান্না করতেন যেটা বর্তমানে “ পাকিস্তানি পেশোয়ারি রেসিপি” নামে পরিচিত। এই রান্নাটা তাঁর খুবই পছন্দের খাবার গুলোর মধ্যে অন্যতম। এদেশে এসে ওই রান্নার তিনি নিজেই তৈরি করতেন। মশলা বিহীন এই রান্না এতোটাই সুস্বাদু যে খুব দ্রুতই আমার নানি এটি রপ্ত করে নিয়েছেন। নানা গত হয়েছেন আমার মায়ের বিয়ের আগেই। কিন্তু নানি তার রন্ধন দক্ষতার অধিকাংশ নানার কাছে থেকেই দীক্ষিত।
কালের বিবর্তনে নানির হাতের এই মশলা বিহীন পেশোয়ারি বীফ/ মাটন/ চিকেন খাবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কি যে মজাদার এই খাবার তা বলে বা লিখে বোঝানো ইম্পসিবল। খুবই সাদামাটা ঢঙের রান্না এটি। মূল উপকরণ হিসেবে যেকোনো ভোজ্য গোস্ত। না হলুদ না মরিচ না তেল ঝালের উপকার।
নানাবাড়িতে গেলে’ই এই ধাঁচের গোস্ত পাকানো অনুরোধ করতাম প্রায়শই। নানুও রাঁধতেন মনের মাধুরী মিশিয়ে। হাঁড়িতে বড় বড় অংশে কাটা গোসত, সামান্য তেল, আস্ত রশুন দুটো তিনটে আস্ত টমেটো, গোটা দুয়েক আস্ত পেঁয়াজ,নুন একসাথে মিশিয়ে। হাঁড়ির ঢাকনা উল্টো করে আটার গোলা দিয়ে সিলগালা করে দিতেন। এরপর ধীমে আঁচে বসিয়ে রাখতেন ঘন্টার পর ঘন্টা। ব্যাস; আর কাজ নাই। এবার শুধু সময়ের অপেক্ষা। সময় ফুরালে নামিয়ে নিয়ে আসা হতো। ঢাকনা খুলতেই গোল্লা পাকানো সুঘ্রাণ যুক্ত ধোয়ায় ছেয়ে যেতো সমস্ত ঘর। গরম সরু ভাতের থালায় পেশোয়ারি গোস্ত নামিয়ে দিতেন নানি; মুখে তখন চিকন হাসি।
পেশোয়ারি রেসিপির বৈশিষ্ট্য
পেশোয়ারি রান্নার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এতে সাধারণত কম মশলা ব্যবহার করা হয়, তবে মাংসের স্বাদ ও গন্ধ ধরে রাখার জন্য বিশেষ কিছু উপাদান ব্যবহার করা হয়। পেশোয়ারি খাবার সাধারণত গ্রিলড, বারবিকিউ বা ধীর-আঁচে রান্না করা হয়, যা একে অন্যান্য পাকिस्तানি খাবার থেকে আলাদা করে।
আজ আমরা তিনটি জনপ্রিয় পেশোয়ারি রেসিপি দেখবো:
- পেশোয়ারি কবাব
- পেশোয়ারি চিকেন কারি
- পেশোয়ারি নান
১. পেশোয়ারি কবাব রেসিপি
প্রয়োজনীয় উপকরণ:
- গরু বা খাসির কিমা – ৫০০ গ্রাম
- আদা-রসুন বাটা – ২ টেবিল চামচ
- কালো গোলমরিচ গুঁড়ো – ১ চা চামচ
- জিরা গুঁড়ো – ১ চা চামচ
- ধনে গুঁড়ো – ১ চা চামচ
- লবণ – স্বাদ অনুযায়ী
- কাঁচা মরিচ কুঁচি – ২ টি
- ধনেপাতা কুঁচি – ২ টেবিল চামচ
- দই – ২ টেবিল চামচ
- লেবুর রস – ১ টেবিল চামচ
- ঘি বা তেল – পরিমাণমতো
প্রস্তুত প্রণালী:
- প্রথমে কিমার মধ্যে সব উপকরণ একসঙ্গে ভালোভাবে মেশান।
- মিশ্রণটি ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা ফ্রিজে রেখে দিন, যাতে মশলা ভালোভাবে মিশে যায়।
- এবার কিমার মিশ্রণ থেকে ছোট ছোট কবাবের আকারে গড়ে নিন।
- গ্রিল বা তাওয়ায় ঘি/তেল ব্রাশ করে হালকা আঁচে প্রতিটি কবাব গ্রিল করুন।
- ১০-১২ মিনিট পর কবাব উল্টে দিন এবং সমানভাবে রান্না করুন।
- সেদ্ধ হয়ে এলে নামিয়ে গরম গরম পরিবেশন করুন।
২. পেশোয়ারি চিকেন কারি রেসিপি
প্রয়োজনীয় উপকরণ:
- চিকেন (মুরগি) – ১ কেজি (৮-১০ টুকরা)
- টক দই – ১/২ কাপ
- আদা-রসুন বাটা – ২ টেবিল চামচ
- জিরা গুঁড়ো – ১ চা চামচ
- ধনে গুঁড়ো – ১ চা চামচ
- দারুচিনি – ১ টুকরা
- এলাচ – ২ টি
- লবণ – স্বাদ অনুযায়ী
- কাঁচা মরিচ – ৩-৪ টি
- ঘি বা তেল – ৩ টেবিল চামচ
- ধনেপাতা ও পুদিনাপাতা কুঁচি – পরিবেশনের জন্য
প্রস্তুত প্রণালী:
- প্রথমে চিকেন ভালো করে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিন।
- এবার এক পাত্রে দই, আদা-রসুন বাটা, জিরা, ধনে গুঁড়ো ও লবণ একসঙ্গে মিশিয়ে চিকেনের সঙ্গে ম্যারিনেট করুন এবং ১ ঘণ্টা রেখে দিন।
- একটি কড়াইতে ঘি গরম করে তাতে দারুচিনি, এলাচ ও কাঁচা মরিচ দিন।
- এরপর ম্যারিনেট করা চিকেন যোগ করুন এবং মাঝারি আঁচে ভালোভাবে কষিয়ে নিন।
- ২০-২৫ মিনিট পর চিকেন সেদ্ধ হয়ে এলে নামিয়ে নিন।
- পরিবেশনের সময় ধনেপাতা ও পুদিনাপাতা ছিটিয়ে গরম গরম পরিবেশন করুন।
৩. পেশোয়ারি নান রেসিপি
প্রয়োজনীয় উপকরণ:
- ময়দা – ২ কাপ
- ইস্ট – ১ চা চামচ
- দুধ – ১/২ কাপ
- দই – ২ টেবিল চামচ
- চিনি – ১ চা চামচ
- লবণ – স্বাদ অনুযায়ী
- ঘি – ২ টেবিল চামচ
- কালোজিরা – ১ চা চামচ
প্রস্তুত প্রণালী:
- প্রথমে একটি বাটিতে উষ্ণ দুধের সাথে ইস্ট ও চিনি মিশিয়ে ১০ মিনিট রেখে দিন।
- এবার ময়দার সাথে লবণ, দই ও ঘি মিশিয়ে নিন।
- ইস্ট মিশ্রণটি ময়দার সাথে মিশিয়ে নরম ডো তৈরি করুন।
- ডোটি ২ ঘণ্টা ঢেকে রেখে দিন যাতে ফুলে ওঠে।
- এবার ছোট ছোট বল তৈরি করে রুটি আকৃতির নান বানিয়ে নিন।
- উপরে কালোজিরা ছিটিয়ে নিন এবং ১৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওভেনে ১০-১২ মিনিট বেক করুন অথবা তাওয়ায় ঢেকে রাখুন।
- গরম গরম ঘি ব্রাশ করে পরিবেশন করুন।
উপসংহার
পেশোয়ারি খাবার তাদের অনন্য স্বাদের জন্য সারা বিশ্বে জনপ্রিয়। এই সহজ রেসিপিগুলো বাড়িতে তৈরি করে আপনিও আসল পেশোয়ারি স্বাদ উপভোগ করতে পারেন। আপনি যদি মশলা কম পছন্দ করেন, তবে এটি আপনার জন্য উপযুক্ত হবে। আশা করি এই রেসিপিগুলো আপনার রান্নার তালিকায় নতুন মাত্রা যোগ করবে।
আপনি যদি পেশোয়ারি খাবার পছন্দ করেন, তাহলে নিচে কমেন্ট করে জানান আপনার প্রিয় রেসিপি কোনটি! Bangla Trends